চিম্বুক পাহাড় নীলগিরিতে ম্রো জনগোষ্ঠীর নিজস্ব জায়গা দখল করে পাচঁ তারকা হোটেল নির্মাণ করে যে উন্নয়ন আনতে চাওয়া হচ্ছে তা আসলেই প্রশ্নের বিষয়।
শিক্ষা ছাড়া জাতি উন্নতি করতে পারে না। শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশ, জায়গা উন্নতি করতে পারে না। সেই চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরিতে কোনো সরকারি বিদ্যালয় নেই। সেখানে বিদ্যালয় স্থাপন না করে, নির্মাণ করা হবে পাচঁ তারকা হোটেল।
উন্নয়ন প্রকল্প বরাবরই বিফলে গিয়েছে কিছু প্রকল্প ছাড়া। তার প্রধান কারণ উড়ে এসে জুড়ে বসা অর্থাৎ যে জায়গায় কাজ করা হবে সেখানের প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা না বিবেচনা করে, স্থানীয় মানুষদের সাথে না বসে, কিভাবে ওই জায়গা চলছে তা না বিশ্লেষণ করেই উন্নয়নের নামে প্রকল্পের কাজ করা হয়।
নীলগিরিতে যে সো কল্ড উন্নয়ন আনতে যাচ্ছে সেটা শুধু সেখানকার বসবাসরত ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবনে অন্ধকার আনবে না, সেই সাথে পরিবেশ বির্পযয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তার বাস্তব উদাহরণ সাজেক। সেখানে পাচঁ তারকা হোটেল নেই ঠিক কিন্তু যা কিছু সংখ্যক হোটেল আছে।
সেখানে যে উন্নয়ন হয়েছে তা বলা যাবে না। নামে মাত্র এই উন্নয়নের ফলস্বরূপ অনেক স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভুমিদখল হয়েছিল। বর্তমানে প্লাস্টিকবর্জ্য সাজেক এলাকাজুরে দেখা দিচ্ছে তা যে কি পরিমান পরিবেশের ক্ষতি করেছে তা বর্ণনাতীত এবং ভবিষ্যতে তার ফল ভয়াবহ।
এখন কথা হলো, হোটেল নির্মাণেই কি উন্নয়ন অবধারিত? হোটেল নির্মাণে অবকাঠামো উন্নয়ন হবে কিন্তু তা কি সেই পরিবেশের জন্য উপযুক্ত! অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি হবে স্থানীয় গোষ্ঠীর?
পার্বত্যাঞ্চলের বেশীরভাগ হোটেল নির্মাণকারীগণ স্থানীয় নন। সেই সব হোটেলের কর্মী হিসেবে স্থানীয় মানুষ, বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের নেওয়া হয় না। কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বাইরের মানুষদের। স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসীদের না নিয়ে নেয়া হচ্ছে সেটেলার বাঙ্গালীদের। আদিবাসীর উন্নয়নের নামে আসলে কাদের উন্নয়ন করানো হচ্ছে!
কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি যেখানে সেটেলার বাঙ্গালীদের ঘর-জমি উচ্ছেদ করে উন্নয়ন ঘটানো হবে, পর্যটনকেন্দ্র করা হবে। তবে কেন এমন আচরণ করা হচ্ছে আদিবাসীদের সাথে যারা বহু বছরের পর বছর বসবাস করছে। এরূপ আচরণের মূলমন্ত্র কি আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের তাড়ায় দেয়া,শাসন করা? এরকম উন্নয়নকর্মীরা কি শুধুই মাটি চায়? নাকি মাথাও চায়? সেই সাথে কি রক্তও চায়?
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে প্রকৃতির ঠান্ডা হওয়া,গরম হওয়া, ভ্যাপসা হওয়া তারপর সেই পরিবেশ উপযুক্ত জিনিসপত্রের সাথে থাকা-খাওয়া এসব অনুভব করলেই না হবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা। সেখানে কিসের পাঁচ তারকা হোটেল!
এক-দু সপ্তাহ ঘুরতে আসার জন্য পুরো পাহাড়, পাহাড়ের মানুষ, পাহাড়ের পরিবেশ ধ্বংস করার কোনো মানে নেই।
বাংলাদেশের বিদ্যমান পার্বত্য এলাকা হলো খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান জেলা। এই তিন পার্বত্য এলাকার মধ্যে বান্দরবান অঞ্চলে বেশি পাহাড় অবস্থিত। পাহাড় অঞ্চলে বরাবরই পানির সংকট রয়েছে।সেখানে নীলগিরি পাহাড় বেষ্টিত এলাকায় পানির সহজপ্রাপ্যতা আশা করা কঠিন।
সেখানে ম্রো জনগোষ্ঠী ছাড়াও আরও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস করে।তাদের প্রত্যেককে বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার জন্য কষ্ট করতে হয়। অনেক পথ হেটে পানি সংগ্রহ করতে হয়। সেরকম একটা জায়গায় পাচঁ তারকা বানানো,পরিচর্যা করার জন্য অনেক পানির প্রয়োজন যার জন্য নির্মাতারা অবশ্যই স্থানীয় এলাকার পানি সংগ্রহ করবে। পাঁচ তারকা হোটেলে শুধু জমি নয়,স্থানীয় মানুষের পানিও তারা কেড়ে নিতে দ্বিধা করবে না।
এই যে উন্নয়ন হবে বলা হচ্ছে, আসলেই কি সেখানে বসবাসরত মানুষের উন্নয়ন হবে?
কি উন্নয়ন হতে যাচ্ছে তা সাজেকের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
নভেম্বরের ৮ তারিখ ২০২০,ম্রো জনগোষ্ঠীরা ‘কালচারাল শোডাউন’ নামক মিছিলের মাধ্যমে প্রস্তাবিত ম্যারিয়ট পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের বিরোধিতা জানায়। এই হোটেল নির্মাণে, ম্রো-দের ৫-৬ টি গ্রামের উচ্ছেদ হবে। কালচারাল শোডাউন মিছিলের মাধ্যমে ম্রো-রা তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তুলে ধরে।
ম্রো জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অন্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যার তুলনায় অনেক কম। ম্রোরা সংখ্যালঘিষ্ট, তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। এই পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ তাদের জাতিসত্তা বিলুপ্তির প্রান্তে নিয়ে যাবে।
এই প্রতিবাদের মাধ্যমে জানান দেওয়া হয়েছে যে, সংখ্যালঘিষ্ট আদিবাসীদের পাশে যেন সংখ্যাগরিষ্টরাও এগিয়ে আসুন। বাংলাদেশের মানুষ হয়ে বাংলাদেশের প্রকৃতি, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার।
ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রথমে সাজেক ধ্বংস করা হয়েছে, এখন নীলগিরি এরপর আরো অনেক এলাকা,জায়গা ধ্বংস করবে যদি না আমরা এখন থেকেই সোচ্চার হই।
এরকম চোখের সামনে দিয়ে কিছু না করে ধ্বংস হওয়া দেখে যাওয়া আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল না। আমাদের ভবিষ্যত আমাদের হাতে। ভবিষ্যত আমাদের দিকে চেয়ে আছে ।
0 Comments