সংযুক্ত পেইন্টিংঃ শিল্পী তুফান রুচ
সাজেক একটি ইউনিয়নের নাম যা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন; যেটি দেশের বৃহত্তম জেলা রাঙামাটি এবং বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত।
‘রাঙামাটির ছাদ’ নামে পরিচিত এবং ভারতের মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত এই সাজেক ভ্যালীর সাজেক ইউনিয়নের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে মিজোরাম এবং পশ্চিমে দীঘিনালা অবস্থিত।
খাগড়াছড়ি থেকে এর দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার, আর দীঘিনালা থেকে খাগড়াছড়ির দুরত্ব ২১ কিলোমিটার। তাহলে দীঘিনালা থেকে সাজেকের দূরত্ব নিজে বের করতে পারবেন বৈ কি!
সাজেক ইউনিয়ন অনেকগুলো গ্রাম নিয়ে গঠিত। আর রুইলুই পাড়া ও কংলাক পাহাড় নিয়ে গঠিত সাজেক ভ্যালী /সাজেক পর্যটনের সৌন্দর্য প্রচারিত হয় ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ সালে খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান “ইত্যাদি ” তে।
এই সাজেক ভ্যালীতে যেতে পাড়ি দিতে হয় দীঘিনালার বাঘাইহাট এলাকা। যেতে যেতে রাস্তার পাশে দেখা মিলবে পাহাড়িদের “এক সুরুঙ্গে ঘর”। অর্থাৎ এক পলকেই বাড়ির ভিতরে যা আছে সব দেখা যায়। বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরী এই বাড়িগুলোর দিকে তাকালে তাদের চরম দরিদ্রতার আভাস মিলে।
সাজেক পর্যটনে আসা -যাওয়া করা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা “বাবুদের ” বাহনকারী চাঁদের গাড়ি থুক্কু জীপ গাড়ি যখন ফুল স্পিডে ৬০° আঁকাবাঁকা পথে চলে তখন সেই দরিদ্র পরিবারের ছোট্ট ছোট্ট শিশুমণিরা “টা, টা” জানায়। আমি অবাক হয়েছি রাস্তায় যতগুলো শিশুদের দেখেছি সবাই টা টা দিচ্ছে। মনোবিজ্ঞানের শিক্ষণ পদ্ধতির মতোই! এই শিশুদের পরনে ময়লা ও ছেঁড়া জামা, উসকো খুসকো চুল। কারো কারো পরনে আবার প্যান্ট নেই, ন্যাংটা। চোখগুলো ছোট ছোট, নাক চ্যাপ্টা।
নিষ্পাপ এই শিশুগুলো এখনো বুঝতে অক্ষম যে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যের অধিকার সঠিকভাবে পাচ্ছে না। এদেরকে আবার শিক্ষিত করে লাভ করে কি তাই না? শিক্ষিত হলে সংস্কৃতি চর্চার দিকে যেমন সচেতন হবে, তেমনি রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হলে নিজেদের বঞ্চিত, বঞ্চনার বিরুদ্ধে দু’এক বাক্য বলতে পারবে। তাই নিরক্ষর থাকাই ভাল। কেননা এতে তাদেরকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করা যাবে। কিশোরীদের পতিতাবৃত্তিতেও।
আসা যাওয়ার পথে দেখলাম যারা শিশু থেকে “মেয়ের” দলে প্রবেশ করেছে তারা সেজেগুজে বাড়ির ভিতরে বসে আসে। মনে হচ্ছে কোন এক মেলায় যাওয়ার জন্য তারা তৈরী।
যা হোক, এই অঞ্চলে জুমচাষ বাদে দু বেলা ভাত খাওয়ার মত কাজের সুযোগ কম। এই অঞ্চল সংরক্ষিত বনাঞ্চলও। সবজি চাষ যে করবো, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি যে পালন করবো তার উপায়ও কম। কেননা এগুলোকেও খাবার দিতে হবে। এদের পেটে খাবার যাবে যদি নিজেদের পেটে খাবার থাকে।
বাই একবাক্যে স্বীকার করে যে, পানির অপর নাম জীবন। সেই “জীবন” বা পানিরও অভাব এখানে। আমি জানি না তারা খাবার পানি পাচ্ছে কোথা থেকে। এই পাহাড়ের উপরে টিউবওয়েল স্থাপনও অসম্ভব। হয়ত ছোট ঝিরির পানি ব্যবহার করছে। সেখান থেকে নিয়ে আসতেও কত কষ্ট। বড় বড় পাহাড় বেয়ে কোলে করে হাড়ির সাহায্যে নিয়ে আসা অনেক কষ্টের কাজ। তারপরও তারা ভুক্তভোগী।
তবে পয়সা থাকলে এগুলোর অভাবই থাকবে না। যেমনটা রুইলুই পাড়ায় অবস্থিত সাজেক পর্যটন ও আর্মি, বিজিবি ক্যাম্পে অভাব নেই। পর্যটনে গেলে মনে হয় যেন এ বিরাট বিলাসিতা! অথচ এই সাজেকেই গতবছর এই সময়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। পাহাড়ের আপামর জনসাধারণ এবং চাকমা সার্কেল ও সমতলের কিছু হৃদয়বান মানুষের সহযোগিতায় অল্প সময়ের জন্যে তা কেটে গিয়েছিল।
গত ৬ এপ্রিল বেড়াতে গিয়ে অনুভব করে এসেছি তাদের এই কষ্টগুলো। অনেকের হইতো সকালে খাওয়ার পর বিকালের খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হয়। বাঘাইহাট এলাকাতে চাকমাদের বাড়িঘর আছে। আর সাজেক ভ্যালীর রুইলুই ও কংলাক পাড়ায় পাংখোয়া, লুসাই এবং ত্রিপুরাদের বসবাস।
সাজেক পর্যটন হবার আগে সেই জায়গাতে খুমি ছিল বলে কথিত আছে। হয়তো পর্যটনের কাছে তাদের বসতির বিসর্জন দিতে হয়েছে। সেখানে এখন আমরা আনন্দ করতে পারি, মুখ বাঁকা করে সেলফি মারতে পারি। এজন্যে ১৮০০ ফুট উচ্চতার কংলাক পাহাড় হয়তো নিরবে কেঁদে উঠে।
তিন পার্বত্য জেলার সর্ব উত্তরের বিজিবি এবং আর্মি ক্যাম্প এখানে। এই সাজেকে ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল এবং ২৯ এপ্রিল সেটলার বাঙালিরা হামলা করে এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। ঘটনার শিকার বুদ্ধপুদি চাকমার নাম এই ঘটনার সাথে জড়িত।
জুমচাষের উপর নির্ভর এই অঞ্চলে বড় বড় পাহাড়ের মাথায় একটি ঘর, অপর আরেকটি পাহাড়ের মাথায় আরেকটি ঘর। বর্তমানে পর্যটনের ফলে যে রাস্তা হয়েছে তাতে গাড়ি দিয়ে যাতায়াতও অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। ইমার্জেন্সি রোগীদের হাসাপাতালে নেয়ার প্রয়োজন হলে কি অবস্থা যে হবে অকল্পনীয়।
এই জায়গা থেকে কম প্রত্যন্ত অঞ্চল হয়েও আমাদের গ্রামে যেমন এখনো বিদ্যুৎ নেই,খাওয়ার পানির সমস্যা, স্বাস্থ্য সেবা অনিশ্চিত সেখানে এই সাজেকে এইগুলা কল্পনা মানে বিলাসিতা। আমার ধারনা রাত ৭/৮ টা বাজলে এখানকার বাড়িগুলোতে অন্ধকার ছেয়ে বসে।
১৫৭২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই সাজেক ইউনিয়নের শিক্ষার হার মাত্র ২১%। আমাদের দেশে শুধু নিজের নামটি লিখতে পারলেই তাকে শিক্ষিতের হারে যোগ করা হয়। তাহলে ভাবুন! এই ছবিগুলোতে দেখুন তারা গ্রাম করে বসবাস করছে। যেখানে আমরা কয়েক মিনিট পাহাড় উঠতে নামতে হাপিয়ে উঠেছিলাম তারা সেখানে পাড়া বা গ্রাম করেছে। কতটা পরিশ্রমী, সাহসী হলেই সম্ভব!
১৭৮০ ফুট উচু রইলুই পাহাড় এবং ১৮০০ ফুট উচু কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ভারতের লুসাই পাহাড় (যেখান থেকে কর্নফুলী নদীর উৎপত্তি) দেখতে দেখতে একটা দীর্ঘশ্বাস টানুন এখানকার অধিবাসীদের কষ্টটুকু উপলব্ধি করে, তাদের সংগ্রাম দেখে । এই হাজারো জর্জরিত সমস্যা দেখে তাদেরকে না হয় কোটা অধিকারের জন্য হেয় না করি। যদিও গুগলে সার্চ করলে এই অঞ্চলে দুই একটি বিদ্যালয়ের দেখা মিলে তারপরও বিদ্যালয়গুলোতে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ পরবর্তী স্তরের সাথে শিশুরা অপরিচিত তা নিশ্চিত।
হয়তো আরো অনেক বছর তাদের এভাবে পাড়ি দিতে হবে, মেনে নিতে হবে বাস্তবতাকে, ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশকে। আর এই নিরীহ পাহাড়িদের কেউ যদি পরিচয় নির্ধারণ করে দেয় একবার উপজাতি, আরেকবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, এবং কেউ অসভ্য জঙ্গলি, সন্ত্রাসী আখ্যা দিলে হয়তো কেউই এর মর্ম ,অপমান বুঝতেও সক্ষম হবেনা, প্রতিবাদ তো দূরের কথা । থেকে যাবে সহজ-সরল, খাবে ঠকা, হবে ব্যবহৃত।
লেখকঃ ভিন্নসুর
0 Comments