নিম্নের লেখাটি বিবিসি পোডকাস্টের নিবেদিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে বানানো ফিল্ম মেকার এবং সাংবাদিক লিপিকা পেলহামের অডিও ডকুমেন্টারি Bangladesh’s Hidden Shame এর অনুবাদ। সম্পূর্ণ ডকুমেন্টারিটি দুইটি অংশে ভাগ করে প্রকাশ করা হবে। আমরা এখানে অডিওর বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছি শুধু। রহস্যজনক কারণে, বিবিসির এই রিপোর্টটি নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। আমরা এর গুরুত্ব অনুধাবন করে এখানে তার বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করছি।
মূল রিপোর্টে যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমি লিপিকা পেলহাম এবং আপনারা এখন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে আমার তৈরি করা এসাইনমেন্টটি শুনছেন।
“মেগছাগা উড়ি যাদন আগাজোন্দি, গাই গাই মুই আদি জাঙর পত্তানোন্দি……”
এই বালিকারা কোন এক প্রেমিককে উদ্দ্যেশ্য করে এই গানটি গাইছে।
“এক গাদা শুভ্র নরম মেঘের নিচে, হেঁটে যাচ্ছি আমি গ্রামের মেঠো পথ ধরে”
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবিক জীবনযাত্রার সাথে এই গানটি সম্পূর্ণ বিপরীত। এইখান থেকে প্রতিনিয়ত খবর আসে শুধুই মানবাধিকার লঙ্ঘনের, অত্যাচারের, ধর্ষণের।
এক কিশোরী আমার সাথে কথা বলার জন্য তার গ্রাম থেকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছিলো। সে আমাকে তার কাহিনী শোনায় যেটি ছিলো খুবই অপ্রীতিকর।
সে আমাকে বলে “ধর্মীয় এক অনুষ্ঠান হতে বাড়ি ফেরার পথে আমাকে চারজন সেটেলার বাঙ্গালি ধরে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করে” ।
এখানে আসার পর আমি যেসব জঘন্য ঘটনাগুলোর কথা জানতে পারি তার মধ্যে এটি ছিলো একটি।
আমার যাত্রা শুরু হয় বাসে করে বান্দরবানের উদ্দ্যেশ্যে, যেটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত একটি জেলা। স্থানীয় আদিবাসী মানুষ যারা কিনা বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার আগে সেখানে স্বায়ত্বশাসনের মধ্যে দিয়ে বসবাস করে আসছিলো, তাদের বিদ্রোহের পর থেকে এই অঞ্চলটিকে জোরদারভাবে সামরিকীকরণ করা হয়।
(ফলশ্রুতিতে স্থানীয়দের) এই বিদ্রোহটি শুরু হয়, যখন স্থানীয় আদিবাসী মানুষেরা তাদের জন্যে ব্রিটিশদের বানানো “বিশেষ আইন” টি হারিয়ে ফেলে, যে বিশেষ আইনের নিয়ম অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের বহির্ভূত কেউ সেখানকার অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করতে পারবে না এবং এই বিদ্রোহটি শেষ হয় ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির মাধ্যমে।
কিন্তু শান্তিচুক্তির পরেও আর্মিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের অবস্থান জারি রেখে যায়। তাদের অনুমতি ও তত্ত্বাবধান ছাড়া বিদেশী সংবাদ মিডিয়াকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না এবং স্থানীয় আদিবাসী মানুষেরাও তাদের মুখ খুলতে পারেনা। সেইকারণে আমি সেখানে ঢুকার জন্যে ২০০ টাকা (৩ আমেরিকান ডলার) দিয়ে একটি নকল পরিচয় পত্র কিনে নিই।
“আমরা মাত্র বান্দরবানে প্রবেশ করলাম। বান্দরবান সদরে পৌঁছানোর ৫ কিলোমিটার আগে প্রধান সড়কের দুইপাশই পুরো ভর্তি ছিলো ঘন জনবসতিতে। কিন্তু এখানে আসার পথে যে জিনিষটা আমি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করি সেটি হচ্ছে আমি আশা করেছিলাম আমি পথে আদিবাসী মানুষদের জনবসতির দেখা পাবো যেহেতু এটি তাদের জন্মস্থান কিন্তু আমি পথিমধ্যে একজন আদিবাসী মানুষেরও মুখ দেখতে পাইনি।
যেই কারণে এখানে কোন আদিবাসীর দেখা পাওয়া যায়না সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ১০ হাজারে্রও অধিক বাঙ্গালীকে এইখানে পুনর্বাসিত করে এই অঞ্চলটিকে বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে তৈরি করছে।
এই অঞ্চলটি ১৩টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্মস্থান যারা কিনা সবাই মিলে দেশের মোট ১৬ কোটি জনসংখ্যার শুধুমাত্র ১% অংশ । তাদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বড় চাকমা,মারমা,চাক, ম্রো এবং তারা বেশিরভাগই থেরোবাদী বৌদ্ধ ধর্ম পালন করে যদিওবা বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী মুসলিম।
এখন সকাল ৭ টা বাজে। আমি এবং আমার টিম প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছি আমাদের গাইডদের জন্যে যারা আমাদেরকে বগালেকে নিয়ে যাবে, যেটি একটা সময় এখানকার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রগুলোর একটি ছিলো।
পথিমধ্যে আমরা বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন আদিবাসীদের বাড়ি পরিদর্শন করে যাবো। তাদের বাড়িঘরগুলো সেটলার বাঙ্গালীদের জোরপূর্বক অনধিকার প্রবেশের কারণে ক্রমেই গভীর জঙ্গলের দিকে সরে যাচ্ছে।
আমি নিচুস্বরে কথা বলছি পাছে যদি কেউ শুনে ফেলে। আমাদের এখনো অনেকগুলো চেকপয়েন্ট অতিক্রম করে যেতে হবে এবং আমি চিন্তিত যদি ধরা পরে যাই।
প্রথমে আমাদেরকে রুমা উপজেলার আর্মি ঘাটিতে সই করে যেতে হবে। শুধু তাই নয়, মাত্র তিন মিনিট আগে একটি চেক পয়েন্টে সই করেছি, এখন আবার আমাকে আরেকটি চেকপয়েন্টে সই করতে হচ্ছে। মাত্র তিন মিনিটের গাড়ি রাস্তা এরপরেই আরেকটা চেকপয়েন্ট।
আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সব রেকর্ডিং করছি কারণ তাদেরকে জানতে দেওয়া যাবেনা। অফিসার বললোঃ –“আপনারা দেরী করে ফেলেছেন। জলদি করুন। আপনাদের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এইখানে সই করুন”।
এবং যখনই ভাবলাম এইখানেই সব ঝামেলা শেষ…
আরেকটি চেকপোস্ট।
আমি খুব নার্ভাস। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। অবশেষে তারা বললো আমরা এখন যেতে পারবো।
আমরা এখন বগালেকের পথে যেখানে কিছুদিন আগেই স্থানীয় আদিবাসীদেরকে তাদেরকে তাদের ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সরকারী অফিসারদের সাথে তাদের সংঘর্ষ বাধে।
আমরা এখন পাহাড় বেয়ে বগালেকে উঠছি এবং এই পাহাড়ের রাস্তাটি অনেক সরু এবং দুর্গম। আমরা ভালমতো প্রস্তুত হয়ে আসিনি। আমরা আমাদের সব জামাকাপড় এবং সরঞ্জাম নিয়ে যাত্রা করছি। আমাদের সাথে আছেন বান্দরবান থেকে আসা দুইজন গাইড এবং রুমা উপজেলা থেকে আসা দুজন আর্মি এজেন্ট । তারা আমাদের উপর সর্বক্ষণ নজর রাখবে। আমরা তাদেরকে বলেছি আমরা লেক এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে একটি ফিল্ম বানাচ্ছি।
এখন দুপুর গড়িয়ে ৩টা বাজে। সূর্যের তাপমাত্রা এখন প্রচন্ড গরম এবং আমরা কেউ এইরকম প্রচন্ড গরমের জন্যে উপযুক্ত কাপড় পড়ে আসিনি, আমাদের সাথে কোন ভালো খাবারও নেই। আমাদের সঙ্গে আসা সব গাইডেরা কিন্তু ঠিকই স্যান্ডেল পড়ে এসেছে।
হে ভগবান! কি সুন্দর! যেন কোন এক মহাজাগতিক প্রাণী এই পাহাড়ের চুড়ায় গভীর খনন করে এই লেকটিকে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এই লেকের চারপাশে আদিবাসীদের বাড়ি রয়েছে ঠিকই কিন্তু সেখানে যেতে হলে আমাদেরকে আর্মি ক্যাম্পের ভিতর দিয়ে যেতে হবে।
এইখানে আর্মিদের সব ছাউনি এমনকি পাথরগুলোও লাল-সবুজ রং করা। লাল-সবুজ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রং। তাদের অফিসিয়াল শ্লোগান অনুযায়ী তারা এখানে আছে এখানকার শান্তি বজায় রাখার জন্যে।
কিন্তু যখন আমাদের গাইডদের বগালেকে গোসল করার ফাঁকে আমরা স্থানীয় কিছু আদিবাসী মানুষদের সাথে কথা বললাম তখন তারা আমাদেরকে জানায় যে, তাদেরকে উচ্ছেদ করার পিছনে আর্মিরা জড়িত। তারা কথা বলতে এতোই ভয় পাচ্ছিলো যে আমাদেরকে তাদের কন্ঠস্বরকে বিকৃত করে দিতে হলো যাতে করে তাদের পরিচয় প্রকাশ না পায়।
এতোই তীব্র তাদের আতংক!!
(উচ্ছেদ হওয়া একজন আদিবাসীর ভাষ্য)
“৩ টা বাজার ঠিক কিছুক্ষণ পরে রুমা উপজেলার কার্যনির্বাহী অফিসার কোনো ব্যাজ ছাড়াই হঠাৎ করে তার দলবল নিয়ে হাজির হয় এবং কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই অনেক বাজে ভাষায় এখানকার মানুষদেরকে সন্ত্রাসী বলে গালি গালাজ করতে থাকে।
অফিসারটি আমাদেরকে বলে- “তোমরা এখানে কেনো বাড়ি বানিয়েছো? এটা সরকারের জায়গা। তোমরা এখানে কেনো পানি বিক্রি করছো? আমরা তোমাদের বাড়িঘর সব তুলে দিবো এবং কেউ যদি আমাদেরকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে তবে তাকে গুলি করা হবে।“”
(উচ্ছেদ হওয়া একজন আদিবাসী নারীর ভাষ্য)
“বাড়িঘর উচ্ছেদের শব্দ শুনে আমি আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম। আমি বাড়িতে শুধু আমার বাচ্চাকে নিয়ে ছিলাম। বাড়ির পুরুষেরা সবাই চাষাবাদের কাজে বাইরে ছিলো। আমি দেখলাম তারা কুঠার এবং দা দিয়ে দরজা ভেঙ্গে বাড়ির ভিতরে ঢুকে সব তছনছ করে দিচ্ছে। আমরা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকলাম কারণ তারা পুলিশ এবং বন্দুক-পিস্তল সাথে করে এনেছে।”
প্রায় ৫টা বাজে। আমাদেরকে এখন চলে যেতে হবে। তারমানে আমাদেরকে আবার চেকপয়েন্টের ভিতর দিয়ে ফেরত যেতে হবে এবং দায়িত্বে থাকা সৈন্যরা আমাদের উপর খুশি নয় কারণ কারফিউ সময়ের চেয়ে বেশি সময় অতিক্রম করে ফেলছি আমরা।
সে বলছে- “আপনারা ৪ টার পর এই জায়গা ছেড়ে যেতে পারবেন না”
কিন্তু আমরা কৌশলে আমাদের রাস্তা বের করে নিলাম।
ম্রোদের একটি এলাকায় আমাদেরকে রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। সেখান থেকে কিছু কিলোমিটার দূরেই তারা তাদের একটি উৎসব পালন করছে। আর অন্যসব আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের মতোই ম্রোরাও জঙ্গলের গভীরে সরে গিয়েছে আর্মি ক্যাম্প এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে জায়গা দিতে গিয়ে।
ঐতিহাসিকভাবে চিম্বুক পাহাড়কে ঘিরে থাকা সারি সারি পাহাড়ের উপরে গড়ে তোলা গ্রামগুলোতে তারা বসবাস করতো। এই চিম্বুক পাহাড় পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সুন্দর জায়গা গুলোর একটি কিন্তু তাদেরকে জোর করে গুচ্ছ গ্রাম নামের ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চলে নিয়ে আসা হয় যাতে করে আর্মিরা তাদের উপর নজরদারী করতে পারে।
গ্রামের একজন দাবী করে যে তার উপরে নির্যাতন করা হয় যখন সে নিজের ভিটামাটি ছাড়তে অস্বীকার করে।
(নির্যাতনের শিকার হওয়া গ্রামের সেই আদিবাসীর ভাষ্য)
“আর্মিরা আমাদের এলাকা থেকে অনেক জায়গা দখল করে নেয়। তারা আমাদেরকে কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলেছিলো কিন্তু বেশিরভাগকে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়। প্রায় ৪০০ টি পরিবার উচ্ছেদ হয়।
আমি ম্রো পরিবারদের পক্ষে হয়ে এর প্রতিবাদ করছিলাম সেইকারণে আমাকে চিহ্নিত করা হয়। তারা দরজা ভেঙ্গে আমার ঘরে ঢুকে আমাকে এরেস্ট করে এবং ৮ ঘন্টা ধরে আমাকে নির্যাতন করে। তারা রাইফেলের হাতল দিয়ে আমাকে মারে। তারা আমাকে কারন্টের শক দেয়।“
আমি এখন একটি ম্রো বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছি। বান্দরবানের এক দুর্ঘম এক জঙ্গলের মধ্যে ১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯,১০ টা বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠা ছোট্ট এক এলাকায় , আম গাছে ঘেরা বাড়িগুলো সব ইস্পাতের তৈরি , এবং বেশির ভাগ বাড়ির ছাদ নারকেল গাছের ছাল দিয়ে বানানো। এই মুহূর্তে শুধুমাত্র অল্পবয়সী মেয়েরা এবং শিশুরা বাড়িতে আছে আর বাকি সব নারী-পুরুষ চাষাবাদের কাজে বাইরে আছে।
সকাল হতে হতেই গত রাতের উৎসবের কোন ছিটেফোঁটাও এখন নেই আর। আর্মি চেকপয়েন্টের মধ্য দিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের এই গ্রাম থেকে বের হওয়ার সুযোগ পর্যন্ত নেই। তারা এমনকি সেটলারদের সাথে সংঘর্ষ হওয়ার ভয় ছাড়া জুম চাষও করতে যেতে পারেনা।
গতকাল সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। আমাদেরকে বলা হয়েছিলো যে রাতে উৎসবের শব্দ যদি আর্মিদের নজর কাড়ে তাহলে তারা তাদের উৎসব বন্ধ করে দিবে। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় যে এখানে সবাই কড়া নজরদারীর মধ্যে বাস করে, যার কারণে সবার মধ্যেই একটা ভয় কাজ করে, সবাই কথা বলতে ভয় পায়।
(চলবে)
0 Comments