লেখকঃ ধীমান ওয়াংঝা
সদ্য স্বাগত ইংরেজি নববর্ষ ২০২১ এর ৩ জানুয়ারি তারিখটি জুমপাহাড়ের এক মেধাবী তরুণ বিপ্লবী শ্রী মিঠুন চাকমার ৩য় প্রয়াণ বার্ষিকী। এই দিনে খাগড়াছড়ি সদরের মতো ব্যাপক নিরাপত্তা বেষ্টনী-পীড়িত জেলা শহরে একদল ঘাতক প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি চালিয়ে এই ক্ষণজন্মা বিপ্লবীর জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়।
মর্মান্তিক ও পাশবিক সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার আজো হয় নি। উপরন্তু মিঠুনের হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে চারপাশে আজো নানারূপ রাজনৈতিক বাহাস-বিতর্ক অব্যাহতভাবে চলছেই। আমি আপাতত সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। মিঠুনের কৃতি ও স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই আমার লক্ষ্য।
প্রিয় জুম্ম ভ্রাতা মিঠুনকে আজ আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ঐকান্তিক স্নেহ ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। বোধহয় সাকুল্যে ৩/৪ বারই তাঁর সাথে মোলাকাত ও বাতচিত হয়েছিলো আমার। একবার আমাদের বন্ধু নিউ এজ পত্রিকার এক সাংবাদিক ফোন করে জানালেন, দাদা আমি আপনার বাসার কাছাকাছি আছি। আমার সাথে আরও দুজন বন্ধু আছেন। আপনি দেখলে নিশ্চয়ই তাঁদেরকে চিনবেন। কিছুক্ষণ পর আপনার সাথে দেখা করতে আসছি, ইত্যাদি।
ভেবেছিলাম তাঁরা সবাই বাঙালি বন্ধুই হবেন। কিন্তু দেখলাম, বাঙালি বন্ধুটির সাথে এসেছেন বয়েসে বেশ তরুণ দুজন পাহাড়ি। তাঁদের একজন মোটামুটি হৃষ্টপুষ্ট, কিন্তু আচরণে অত্যন্ত ধীরস্থির, বিনয়ী ও স্বল্পভাষী। সেই বয়েসের বিনয়ী সেই বৈশিষ্ট্যের পাহাড়ি রাজনীতিক বর্তমানে খুঁজে পাওয়া খুব সম্ভবত দুঃসাধ্য একটি কাজ। অবশ্য অন্যজনও ছিলেন প্রায় তাঁরই মতো ধীরস্থির, তুলনায় কিছুটা ভগ্নস্বাস্থ্যমন্ত্রী হলেও। এরপর পরিচিত হয়ে জানলাম, ইনিই আমাদের সেই বিখ্যাত মেধাবী তরুণ বিপ্লবী শ্রী মিঠুন চাকমা, যাঁর কথা একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের স্বনামধন্য অধ্যাপক ডঃ সৌরভ সিকদার আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন।
বলাবাহুল্য, ডঃ সৌরভ সিকদার একজন আদিবাসী বান্ধব শিক্ষাবিদ, মিঠুনের সরাসরি শিক্ষক, বাঙালি সমাজের অন্যতম আলোকিত একজন সদস্য এবং আমাদের পরম বন্ধু ও বিপ্লব-সাথী। ক’বছর আগে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন এনসিটিবি’র কয়েকটি পাঠ্যবই আমি/তিনি/আমরা একসাথে মিলে লিখেছিলাম, সম্পাদনা করেছিলাম।
সেইসব পুস্তক রচনার কাজের ফাঁকে তিনি একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মিঠুন চাকমাকে চেনেন নাকি…তাঁর সাথে আমার কিছু বিষয়ে জরুরি আলোচনা প্রয়োজন…অনেকদিন তার সাথে দেখা হয়না…ইস, ছেলেটি যে কী করলো…ভার্সিটির টিচার হয়ে থাকলে কতোকিছু ভালো কাজই না সে করতে পারতো…কিন্তু সে আমাদের কথা শুনলো না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সৌরভ ভাইয়ের স্বভাবজাত নিরবচ্ছিন্ন বক্তব্যটি শেষ হলে মনে মনে ভাবলাম – একটি বৈষম্যদীর্ণ দুনিয়ায় আমাদের মিঠুন চাকমারা যে এমনই বেপরোয়া বিপ্লবী, স্বাজাত্য চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক হবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী!
যেদিন মিঠুনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় সেদিন আমারই প্রতিবেশি প্রাক্তন ইউপিডিএফ কর্মী/নেত্রী এক ছোটবোন সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরে তাঁর বয়ানে বিস্তারিত জেনেছি। মিঠুনের এক বছর বয়েসি একমাত্র পুত্র তিরোজের তার পিতার বাক্সবন্দি অচেতন কিন্তু দীপ্ত-সমুজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে অনুসন্ধিৎসু কথকতা/আলাপন এবং প্রিয়তমা স্ত্রীর শোকস্তব্ধ অন্তরের নীরব আর্তচিৎকার নাকি সেদিন উপস্থিত সবাইকে শোকাকুল করে তুলেছিলো।
আজ আমাদের প্রিয় মিঠুনের শেষকৃত্যের তারিখটি তাঁর পুত্রেরও জন্মদিন। তাই পুত্র, তোমার এই অভিশপ্ত জন্মদিনে আমার/আমাদের অশেষ স্নেহাশিস, আদর, ভালোবাসা, শুভকামনা গ্রহণ করো। কিন্তু ক্ষমা করো আমাদের, ক্ষমা করে দিও এই নিষ্ঠুর পৃথিবীকে, তার ভণ্ড রাজনীতিকদেরকে – যারা শুধু যুদ্ধ-হিংসা-হানাহানি-অর্থকড়ি-জিঘাংসাকেই ভালোবাসে।
বন্ধুরা ভেবে দেখুন, কী মর্মান্তিক ও ট্র্যাজিক একটি কাজই না করেছেন আমাদের একই জুম্ম চেহারার মিঠুন হন্তারক সেই বিপথগামী, অবিবেচক, অপরিণামদর্শী অঘা প্রতিবিপ্লবীরা এবং তাঁদের মদদদাতা রাষ্ট্র তথা শাসকগোষ্ঠীর সেই কথিত পরিকল্পক ও উস্কানিদাতারা! পুত্র তিরোজের অভিশাপ থেকে তাঁরা এখন বাঁচতে পারবেন কি!
ছোটভাই প্যারিসের একটি নোট থেকে জানলাম, বর্তমানে চাকমা বর্ণমালাটি যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আইনগত স্বীকৃতি অর্জন করেছে এবং অনলাইন দুনিয়ায় সংশ্লিষ্টদের মাঝে চর্চিত হচ্ছে তার পেছনের মহতি কর্মযজ্ঞের পৃষ্ঠপোষকও নাকি ছিলেন আমাদের অপ্রতিরোধ্য সেই তরুণ বিপ্লবী শ্রী মিঠুন চাকমা। শুধু এই একটি কাজের জন্যই তাঁর নাম আমাদের জুম্ম জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বলে মনে করি।
মিঠুন যে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন তথা জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন তা সম্ভব করতে হলে জুম্ম জাতির সকল সদস্যের মাঝে ব্যাপক ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তার জন্য দরকার বুদ্ধ তথাগতের বয়ানকৃত মৈত্রী-করুণার অনুশীলনও। একটি অহিংস, পরিশুদ্ধ অন্তঃকরণ পৃথিবীর যে কাউকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে। তাই আমাদের ধ্যানানুশীলন, ধ্যান-চর্চাকে সেই লক্ষেই পরিচালিত করতে হবে। আগে নিজের অন্তঃকরণের বিশুদ্ধতা আবশ্যক।
পান থেকে একটু চুন খসলেই বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী যে এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে ট্রলের, বিশোদ্গারের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন এবং ইচ্ছেমতো থেজেরা উড়াচ্ছেন, সেই আদিম প্রবণতাটিও বন্ধ হওয়া উচিৎ। কারণ নিজের কোনোরূপ সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা আমাদের পূর্ব প্রজন্মের সমাজপতিদের মাঝে চর্চিত হয়নি বলেই পরবর্তী প্রায় তিন প্রজন্ম ধরে আমরা কিন্তু এখনো সেই হযবরল, সামন্তদুষ্ট গুদোগুদি/ভোগান্তির মাঝেই হাবুডুবু খাচ্ছি।
শুধুমাত্র নিজের অভিমত তথা চিন্তাভাবনাকেই সর্বেসর্বা জ্ঞান করছি। এই প্রবণতার সংস্কার আবশ্যক। তাই নতুন প্রজন্মকে পুরনোদের ঘুনেধরা মানস–কাঠামো থেকে বেড়িয়ে এসে যুযুধান দল/পক্ষগুলোর মাঝে সার্বত্রিক ঐক্য, সুসংহতি প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। তবে সেটি মোটেও রাজনৈতিক ভাওতাবাজি কিংবা কৌশলগত চালবাজি হতে পারবে না। একেবারেই হৃদয়ের গভীর অন্তঃস্থল থেকে, বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে স্বজাতির মুক্তি ও সার্বত্র্যিক কল্যাণের অভিপ্রায়ে ঐ রাজকীয় কাজটি সুসম্পন্ন করতে হবে।
আরেকটি কথা বলি। জাতির দুর্ভাগ্যের জন্য এখন আর পরস্পরকে দোষারোপ করে কোনো লাভ নেই। সব দোষ আসলে নিজেদের সবারই। কবি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের অনুকরণে আমিও এখন দুটো রাস্তাই জুম্মদের জন্য খোলা দেখি। তার একটি হলো ভূ-রাজনীতির নিরিখে জাতিসংঘের সব পক্ষকে আস্থায় নিয়ে তাঁদেরকে জুম্ম জাতির ন্যায্য অধিকার আদায়ে ও সংরক্ষণে ব্রতী করা।
অন্যটি হলো, নিজের হেদাম বুঝে দেশের শাসকগোষ্ঠীর সাথে আন্তরিক সংলাপের মাধ্যমে যতোটুকু সম্ভব অধিকার আদায় করে নেওয়া। আপনারা এখন কোন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করছেন, সেটি মূল্যায়নের সময় উপস্থিত হয়েছে বলে মনে করি। আর দেখুন, আমাদের কী হওয়ার কথা ছিলো, এখন আমরা কী হয়েছি!
পরিশেষে কমরেড মিঠুনের দেহান্তরিত চেতনাপ্রবাহের মুক্তি ও শান্তি কামনা করছি। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সকলের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
0 Comments